Friday, September 30, 2016

নব্য উদারবাদ ও বৈশ্বিক মিডিয়া

রবার্ট ডব্লিউ মাকচেজনি (২০০১) বলেছেন জি-এইটের স্বার্থানুকূল বিশ্বায়নকে বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে নব্য-উদারবাদকে। নব্য-উদারবাদকে না বুঝলে বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন জটিলতা বোঝা যাবে না।  

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে জন লক ও অ্যাডাম স্মিথের মতো অর্থনীতিবিদগণ ক্লাসিক্যাল উদারবাদের ধারণা প্রবর্তন করেন। অনেকে মনে করেন ক্লাসিক্যাল উদারবাদ ও নব্য উদারবাদের মধ্যে পার্থক্য নেই। ১৯৩০ এর দশক থেকে উদারবাদকে নব্য উদারবাদ নামে ডাকা শুরু হয়।

তবে এই ধারণার প্রয়োগ তখনই শুরু হয়নি। নব্য উদারবাদের ধারণার প্রয়োগ শুরু হয় ১৯৮০-র দশক থেকে।

নব্য উদারবাদ ধারণার প্রবর্তক শিকাগো স্কুল অব ইকনোমিক্সের অধ্যাপক মিল্টন ফ্রিডম্যান। আর একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদগণ যাদের “শিকাগো বয়েস” নামে ডাকা হয় তারা এই ধারণার প্রচারক ও চর্চাকারী।

নব্য উদারবাদের ধারণায় দুটি প্রধান দিক রয়েছে। এগুলো হলোঃ

১। অর্থনৈতিক
২। রাজনৈতিক

অর্থনৈতিক বিবেচনায় নব্য উদারবাদ মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলে।

আর রাজনৈতিক বিবেচনায় সেই মুক্ত বাজারে কোন রাজনৈতিক বা সরকারি  হস্তক্ষেপ থাকবে না।

নব্য উদারবাদে এক ধরণের “বাজার মৌলবাদিতা” কাজ করে। এক্ষেত্রে বলা হয়, বাজারই সব অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে দেবে। আর বাজারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ একেবারেই অনুভুত হতে দেয়া যাবে না। বাজার চলবে তার নিজস্ব নিয়মে।
নব্য উদারবাদের ধারণাতে আরও বলা হয় রাষ্ট্র সব কিছুকে বিনিয়ন্ত্রন করবে। যা কিছু পাবলিক খাতে রয়েছে তার বেসরকারিকরণ করতে হবে। পাশাপাশি জনগনের জন্য সরকারের যেসব কল্যানমূলক ও সামাজিক সেবার কর্মসূচি রয়েছে তা হ্রাস করতে হবে।

মাকচেজনির ভাষায় “বিশ্বায়ন” শব্দটির মাঝে এক ধরণের সমস্বার্থের বিষয় রয়েছে যা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর। তার মতে এটি একটি “আদর্শপোরা” শব্দ। বিশ্বায়নের যে আদর্শ ধারণা যে পণ্য-মানবসম্পদ-সংস্কৃতির বিনিময় হবে সারা বিশ্বের মধ্যে বর্তমানে প্রচলিত বিশ্বায়নে তা বাস্তবায়িত হয়নি।

বরং যে বিশ্বায়ন চালু হয়েছে তা নব্য উদারবাদ প্রভাবিত এবং এতে জি-এইট বা পশ্চিমা পুঁজিবাদী বলয়ের স্বার্থ প্রতিফলিত হয়েছে। সেই স্বার্থ বাস্তবায়নের কাজ করে চলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

মিডিয়া ও নব্য উদারবাদঃ

নব্য উদারবাদের ধারণাতে বলা হয় মিডিয়া হবে পুরোপুরি বাণিজ্যিক। যোগাযোগের ক্ষেত্রে যত ধরণের সরকারি বাধা রয়েছে তা দূর করতে হবে। ফলে ১৯৮০-র দশকের পর থেকে বিশ্বের অধিকাংশ গণমাধ্যম বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যেতে শুরু করে।

নব্য উদারবাদের আগে সাংবাদিকতা ছিল রাজনৈতিক আদর্শ ভিত্তিক। যত সময় এগিয়েছে সাংবাদিকতার কাজ নিরেপেক্ষ সংবাদ প্রদান করা নয় বরং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সরবারহ করা।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার যুগ পেরিয়ে আজ আমরা বিশ্বায়নের যুগের সাংবাদিকতায় এসে উপনিত হয়েছি। যেখানে তথ্য হল নিতান্তই একটি পণ্য আর মিডিয়া হলো অন্যান্য সব পণ্য পরিচিতকরণ ও বিপননের উপায়। আশি ও নব্বইয়ের দশকের পূর্বে মিডিয়া ছিল জাতীয়। মালিকানি ছিল সরকারের হাতে। নব্য উদারবাদের উদ্ভবের পরে ব্যাপকভাবে বেসরকারি ও বাণিজ্যিক রেডিও-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের বা কর্পোরেট মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে।

এ প্রসঙ্গে হারবাট শিলার (১৯৯৭) বলেন, “১৯৮০-র দশক পর্যন্ত গণমাধ্যমগুলো সাধারণ জাতীয় মাধ্যম হিসেবেই ছিল। ১৯৮০-র দশকে আইএমআফ, বিশ্ব ব্যাংক এবং মার্কিন সরকার যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য ও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেবার জন্য চাপ দিতে থাকে। এবং নতুন স্যাটেলাইট ও ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবের কারণে বহুজাতিক মিডিয়া দানবের সৃষ্টি হয়।”

“বহুজাতিক মিডিয়া দানব” হলো সমসাময়িক বৈশ্বিক মিডিয়ার অন্যতম প্রবনতা।

একীভবন, অধিগ্রহন ও পুঞ্জীভবনঃ পরিবর্তিত বৈশ্বিক মিডিয়া

নব্য উদারবাদ বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে প্রভাবশালী মতামত। যার মূল কথা হল মুক্ত বাজার অর্থনীতি বা অসম প্রতিযোগিতা।

এই অসম প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে অসাম্য। বড় ব্যাবসা গিলে ফেলছে ছোট ব্যবসাকে। একই ঘটনা ঘটছে গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে। বিশ্বের অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিকানা চলে যাচ্ছে কিছু সংখ্যক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে।

বেন বাগডিকিয়ান তার “মিডিয়া মনোপলি” বইতে বর্তমান বিশ্বের গণমাধ্যমের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি তার বইতে দেখিয়েছেন ১৯৮৩ সালে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি গণমাধ্যমের মালিকানা ছিল ৫০ টি প্রতিষ্ঠানের হাতে। ১৯৮৬ সালে যা কমে ২৯ টি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়। ১৯৯৩ সালে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মিডিয়ার মালিকানা ২০ টি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়।

বর্তমানের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এখন বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমগুলোর অর্ধেকের বেশি মালিকানা মাত্র ৫ টি কোম্পানির হাতে।

এগুলো হলঃ এওএল-টাইম ওয়ানার, ডিজনি, নিউজ কর্প, ভায়াকম, বাটেলসম্যান।
ম্যাকচেজিন বর্তমান সময়ের বিশ্ব মিডিয়াকে বলেছেন, “বড় দানবের ছোট দুনিয়া”। তিনি নব্য উদারবাদের যুগের মিডিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, “দ্রুত বড় হও, অনেক বড় হও অথবা অন্যের পেটে ঢুঁকে পর।”

বড় বড় মিডিয়া কোম্পানি গুলো নিজেদের জায়গা আরও শক্তিশালী করার জন্য নিজেরা একীভূত হয়ে আরও বড় কোম্পানিতে পরিণত হয়। ২০০০ সালে আমেরিকান অনলাইন (এওএল) ও টাইম ওয়ানার মিলে গিয়ে ‘এওএল-টাইম ওয়ানার’ প্রতিষ্ঠা করে।

এটা বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয় বড় মিডিয়া একীভবনের ঘটনা।

নিউজ কর্পের প্রেসিডেন্ট পিটার শারনিন বলেছিলেন, “বাজারের এমন একটা অংশ দখলে রাখতে যাতে অন্যরা আপনার সাথে রফা করতে বাধ্য হয়।”

গুগল ২০১০ সাল থেকে প্রতি সপ্তাহে গড়ে একটি করে কম্পানিকে কিনে নিচ্ছে। গুগল ২০০৬ সালে ১.৬৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ইউটিউবকে কিনে নেয়। এটা অধিগ্রহনের খুব বড় একটি উদাহরণ।

একীভবন ও অধগ্রহনের ফলে বৈশ্বিক মিডিয়া পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ অধিকাংশ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রন কিছু বহুজাতিক কোম্পানির হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় সারির গণমাধ্যম গুলোও বৃহৎ মিডিয়া দানবের সাথে যুক্ত হয়ে জাতে উঠতে চায়। তারাও রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক হতে চায়। ক্যানওয়েস্ট গ্লোবাল কমিউনিকেশনের চেয়ারম্যান ২০০০ সালে বলেছিলেন, “সীমান্ত আর নেই। আমাদের ব্যাপারটা বুঝতে হবে। তথ্য মহাসড়কের পাশে পড়ে থাকা মৃতদেহ হতে চাই না আমরা......। আমাদেরকেও একদিন কলম্বিয়া বা ওয়ানার ব্রাদার্স হতে হবে।”

ফলাফলঃ

১। মিডিয়া কিছু বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়াতে ভিন্ন স্বর কমে গেছে। এখন শুধুমাত্র বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠানের কথা শোনা যায়।

২। গণমাধ্যমে হালকা বিনোদন বেড়ে গেছে। ক্রিটিকাল সমালোচনা খুব একটা দেখা যায় না।

৩। বৈশ্বিক গণমাধ্যম বৈচিত্র্য হারিয়ে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। মূল সমস্যা থেকে জনগনের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা হচ্ছে একটা “কৃত্রিম বাস্তবতা” তৈরি করে।

৪। মিডিয়াতে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছে। মিডিয়া হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাবানদের প্রচারনার হাতিয়ার।

বর্তমান সময়ের মিডিয়ার এই প্রবনতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেছেন “মিডিওলজি”।

তথ্যসূত্রঃ

হক, ফাহমিদুল (২০১৪)। নব্য উদারবাদ, বিশ্বায়ন ও পরিবর্তিত মিডিয়া। ঢাকা, বাঙলার পাঠশালা।

বাগডিকিয়ান, বেন (২০০৪)। মিডিয়া মনোপলি। বোস্টন, বিকন প্রেস।

উইকিপিডিয়া।


2 comments:

  1. লেখাটির জন্য ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. সুন্দর উপস্থাপনা।

    ReplyDelete