বাংলাদেশের গণহত্যা

১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ হত্যাযজ্ঞে প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ বেসামরিক মানুষ শহীদ হয়েছেন। পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ডের অন্যতম। 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সেনানিবাসে অতর্কিতভাবে বাঙালি সেনা সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, আনসার সদর দফতরেও সশস্ত্র হামলা চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক দিয়ে ঢাকা শহর ঘিরে রাখে। তারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বাসভবন ও ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোতে হামলা চালায়। এতে কয়েক শত ছাত্র ও অনেক শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হন। অনেক ঘরবাড়ি ও পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে ও মর্টার হামলা চালিয়ে সেগুলো বিধ্বস্ত করা হয়।
ঢাকার গনহত্যা

অগ্নিসংযোগ করা হয় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতে। ঢাকার অলিগলিতে বহু বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। হত্যাকান্ড শুরুর প্রথম তিন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও অন্যান্য শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। ঢাকার প্রায় ১০ লাখ ভয়ার্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

অপারেশন সার্চলাইট নামে অভিহিত গণহত্যার এ প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান সংহত করে এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা শত শত গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়, হত্যা করে নিরপরাধ গ্রামবাসীকে, ধর্ষণ করে যুবতী-কিশোরীদের, লুণ্ঠন করে মূল্যবান সম্পদ। ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় মানুষ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। মানুষকে হত্যা করে পাকিস্থানি হানাদারেরা তাদের গণকবর দিয়েছে। সারা দেশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি।


গণকবরের ছবি 
প্রেস সেন্সর ও সংবাদ পাঠানোর ক্ষেত্রে বাধানিষেধ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে কোনো সংবাদ বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল না। সে কারণেই বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে শুরুতে কিছু জানতে পারে নি। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ছবিসহ বিদেশি সংবাদপত্র বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করে। কতিপয় সদস্য-দেশ ছাড়া জাতিসংঘ এবং এর অপরাপর সদস্য-দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং পাকিস্তানের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীদের জানাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল, তা ছিল বিংশ শতাব্দীর নৃসংশতম গণহত্যা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়ঙ্কর। পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদেরকে খুন করা হয়েছে, গণহারে নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য গণকবর। যেখানে শায়িত আছে নাম না জানা বহু শহীদ। ১৯৭১ সালে নির্যাতন থেকে বাচতে প্রায় দেড় কোটি মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহন করে। 
ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থী 
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভতাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যাডজ্ঞকে ‘selective genocide’ বা ‘genocide’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পারলো মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরাজয় সুনিশ্চিত তখনই বাঙালি জাতি যাতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে এই হীন চিন্তা থেকে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকান্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়।
কয়েক জন শহীদ বুদ্ধিজীবী 
১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিকটাত্মীয়রা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের গলিত ও ক্ষত-বিক্ষত লাশ খুঁজে পায়। বুদ্ধিজীবীদের লাশে ছিল আঘাতের চিহ্ন। চোখ, হাত-পা ছিল বাঁধা। কারো কারো শরীরে ছিল একাধিক গুলি। অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে। লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি।
পাকিস্থানি বাহিনীর সাথে এদেশীয় দালাল বাহিনী  রাজাকার,  আল-বদর এবং  আল-শামস গণহত্যা ও লুণ্ঠন চালিয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে।
সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৭১ সালে সংঘঠিত মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে এবং কয়েকজন অপরাধীর সাজা কার্যকর হয়েছে। 

No comments:

Post a Comment